অনেক করোনা রোগীই একটা আইসিইউ বা একটা শয্যার খোঁজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে পথেই মৃত্যুবরণ করেন। আবার কোনো কোনো করোনা রোগী পান রিতীমতো রাজকীয় সেবা। তেমনই এক করোনা রোগী একজন সচিবের ৯৫ বছর বয়সী মা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি এখন হাসপাতালে। সচিব মহোদয় হাসপাতালে তাঁর মায়ের দেখাশোনার জন্য ২৪ জন সরকারী কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেছেন। তাঁরা ছয় ঘণ্টার পালা করে অসুস্থ মা কে দেখাশোনা করেন। এই ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব সমন্বয় করছেন সচিবের একান্ত সচিব।
ঘটনাটা মায়ের প্রতি সন্তানের অসাধারণ ভালোবাসারই প্রকাশ। ৯৫ বছর বয়সী মাকে বাঁচাতে সম্ভব সবকিছুই তিনি করেছেন। ঘটনার এতটুকু মানবিক এবং সুন্দর। মায়ের প্রতি এমন ভালোবাসায় অনুপ্রেরণা আসে। কিন্তু মুশকিল হলো, যাঁরা এই দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা সচিব মহোদয়ের নিজ দপ্তরের কর্মচারী। তাঁরা যে দায়িত্ব পালন করছেন, তা তাঁদের চাকরির অংশ নয়। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে সেই প্রজাতন্ত্রের কাজ ফেলে সচিব মহোদয়ের ব্যক্তিগত কাজ করে যাচ্ছেন। এর কোনো প্রবিধান কি সরকারি কোনো নির্দেশিকায় আছে?
অথচ যাদের সরকারী সেবা পাওয়ার কথা তারাই চরম অবহেলিত। আমরা দেখেছি মোটরসাইকেলে স্ত্রীকে পিঠে বেঁধে হাসপাতালের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্বামী। আমরা দেখেছি হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে, প্রতিবেশীদের আতঙ্কের চাপে পড়ে অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছেন সন্তানেরা। আবার আমরা এও দেখেছি, ছেলের জন্য নিজের আইসিইউ শয্যা ছেড়ে দিয়েছেন মা। ছেলের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে চলে গেছেন। বলা যায় বাধ্য হয়েছেন এই আত্মত্যাগে। তারা তাদের প্রয়োজনের সময় পাননি সরকারী সেবা।
ভয়ের জঙ্গলে ফেলে আসা মায়ের সন্তানেরা নিষ্ঠুর ছিলেন না। স্বজনকে হাসপাতালস্থ করা কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করায় ব্যর্থ মানুষেরাও নির্দয় ছিলেন না। ছিলেন তারা অসহায়। সেই অসহায়ত্ব তৈরি করে দিয়েছে রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রণালয়। এমনকি আমাদের সচিবালয়ের সচিবেরা, যারা নাকি বর্তমানে সরকারের প্রধান খুঁটি, তারাও নিজেদের জন্য যা পারেন করেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ কেবল অসহায়ত্বই বোধ করেছেন রোগে-শোকে আর অভাবে–অক্ষমতায়। অক্ষমতার সেই জ্বালাধরা চোখে ক্ষমতাবানের ভালোবাসাকে নিরীহ মনে নাও হতে পারে।
আমরা চাই সচিব মহোদয়ের প্রাণপ্রিয় মাতা সুস্থ হয়ে উঠুন। সাথে সাথে আমরা চাই, সাধারণ মানুষের প্রতিও তারা যেন একটু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি ছিটিয়ে দেন। তাতে অনেকের প্রাণ বাঁচবে, অনেকে অসহায়ত্ব আর অক্ষমতার জ্বালায় ছটফট করবেন না। নিজের কোলের মধ্যে অসুস্থ স্বজনের মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না, এমন স্মৃতি তাদের সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে না।