25 January 2016

বাকশাল তথ্যঃ কি এবং কেন?

স্বাধীনতার পর অচিরেই মুজিব সরকারকে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ সামাল দিতে হয়। তাঁর রাষ্ট্রীয়করণ ও ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সমাজতন্ত্রের নীতি অপ্রশিক্ষিত জনবল, অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি আর দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুজিব অতিমাত্রায় জাতীয় নীতিতে মনোনিবেশ করায় স্থানীয় সরকার প্রয়োজনীয় গুরুত্ব লাভে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ণাঙ্গরূপে রাষ্ট্রীয় কররমকান্ড নিয়ন্ত্রণ করায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় তৃণমূল পর্যায়ে কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ইসলামি দলগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করায় ইসলামিক গোত্রের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনজনদের নিয়োগ দেয়ার জন্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্য সংকট আরো বাড়িয়ে দেয় এবং অর্থনীতির প্রধান উত্স কৃষিকে ধ্বংশ করে ফেলে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, দ্রব্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সংঘাতের মাত্রা বাড়তে থাকায় মুজিবও তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে থাকেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মুজিব জরুরি অবস্থা জারি করেন। ১৯৭৫ এ কয়েকটি দল মিলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দল গঠন করে। সংক্ষেপে বাকশাল নামে পরিচিত .এই নতুন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হবেন। বাকশাল-বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। দলটি প্রত্যন্ত জনসাধারণ, কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের বিবেচিত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। দলটি বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। সরকারি বাহিনীর সাথে সমর্থকদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেন এবং সারাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। রক্ষী বাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারীরা মুজিবের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ডকে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারবিরোধী বলে গণ্য করেন। মুজিবের বিরোধীরা অসন্তোষ ও সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তার এই নীতির ফলে অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দুর্নীতি,কালোবাজারী এবং অবৈধ মজুদদারি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়।

বাকশালের বিস্তারিত তথ্য:

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি (শনিবার) চতুর্থ সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার পরদিন ২৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক সংশোধনী বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করে। ওইদিনের ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘জাতীয় দল গঠন’ এবং ‘রাষ্ট্রপতি' সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে ধরা হলো:
১১৭-ক। জাতীয় দল :- (১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতিসমূহের কোনো একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি, আদেশ দ্বারা, নির্দেশ দিতে পারিবেন যে রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে।
(২) যখন (১) দফার অধীনে কোনো আদেশ প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন।
(৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কার্যসূচি, সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃঙ্খলা, অর্থসংস্থান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা পরিচালিত হইবে।
(৪) (৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত আদেশ সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যোগ্য হইবেন।
(৫) এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যখন জাতীয় দল গঠিত হয়, তখন কোনো ব্যক্তি—
(ক) যদি তিনি যে তারিখে জাতীয় দল গঠিত হয়, সেই তারিখে সংসদ সদস্য থাকেন, তাহা হইলে তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় দলের সদস্য না হইলে সংসদ সদস্য থাকিবেন না এবং সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
(খ) যদি তিনি জাতীয় দলের দ্বারা রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত না হন, তাহা হইলে অনুরূপ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচিত যোগ্য হইবেন না।
(গ) জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোনো দল গঠন করিবার বা অনুরূপ দলের সদস্য হইবার কিংবা অন্য কোনো অনুরূপ দলের কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিবার অধিকারপ্রাপ্ত হইবেন না।
(১) এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোনো আদেশ পরবর্তী কোনো আদেশ দ্বারা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বলবত্ থাকিবে।
৩৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয় : সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে,
(ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে।
(খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন, যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত বিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২৬ জানুয়ারি রোববার ১৯৭৫)

এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠন সংক্রান্ত আদেশটি পরদিন অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাক হুবহু প্রকাশ করে। ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত বাকশাল গঠন সংক্রান্ত আদেশটি তুলে ধরা হলো:

১নং আদেশ
প্রেসিডেন্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র—এই মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহের পূর্ণতাদানের উদ্দেশ্যে দেশে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের নির্দেশ দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়াছেন। অতএব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭-ক অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট দেশে এখন হইতে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকিবে বলিয়া নির্দেশ দান করিতেছেন।

২নং আদেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭-ক অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট নিজেকে চেয়ারম্যান করিয়া বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি জাতীয় দল গঠন করিয়াছেন। ইহার সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা তিনিই গ্রহণ করিবেন এবং ইহার পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে।

৩নং আদেশ
রাষ্ট্রপতি অন্য কোনো নির্দেশ দান না করিলে জাতীয় সংসদের অবলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রিগণ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য বলিয়া গণ্য হইবেন। প্রেসিডেন্ট দলীয় সংগঠন নির্ধারণ না করা পর্যন্ত—অবলুপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত অন্যান্য সকল কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কমিটি রূপে কাজ চালাইয়া যাইবে। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৭৫)