21 August 2019

স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশঃ ব্যর্থতার কিছু কারণ অনুসন্ধান

সাল ১৯৭১। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ কেবল স্বাধীন হলো। লক্ষ লক্ষ জনতার প্রাণপণ যুদ্ধে স্বাধীন হলো দেশ। কিন্তু কেনো তাঁরা প্রাণ বাজী রেখে যুদ্ধে নেমেছিলো? মানুষ এমনি এমনি যুদ্ধ করে না। ভালো একটা সমাজের আকাঙ্খা থেকেই যুদ্ধ করে। তাই যুদ্ধের বিনিময়ে তাদেরও অনেক পাওনা থাকাটা খুব স্বাভাবিক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাও ছিল নানান আকাঙ্খায় ভরপুর। সবাই ভেবেছিল নতুন দেশটা একেবারে নতুন করে যাত্রা শুরু করবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো সেটি আসলে কেমন করে অগ্রসর হচ্ছিলো? এই বিষয়গুলো আমাদের জানা দরকার। আসলে আমাদের দেশে কথা না বলার একটা ভয়ংকর সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়ে গেছে যার কারণে কেউ এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সাহস পান না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ যে একটা ধ্বংসস্তুপ ছিল এ ব্যাপারে অন্য সবার সাথে আমি একমত। কিন্তু এই একমত হওয়ার মাধ্যমে ওই সময়কার বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ করা যাবে না। এ ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়াগুলোই বলে দিবে সেই সময় বাংলাদেশটা কেমন ছিলো। এটা ঠিক ওই যুদ্ধে আমাদের অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একাত্তরের পর এই দেশটা তো আমাদের। আমরা কি সেই ক্ষত পুণরুদ্ধারে আন্তরিক ছিলাম? আমাদের দেশের অর্থনীতির ভিত্তি তখন ছিল পাট। এখনকার মত পোশাক শিল্প তখন বিকশিত হয় নি। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও দেশে পাটের উৎপাদন হয়েছে ব্যাপক। কিন্তু প্রত্যেক বছর বিশাল অংকের পাট পাচার হয়েছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। এর পেছনে কারণ ছিল দুটি। প্রথমত সরকার পাটচাষীদের দায়িত্ব নেয় নি। তাই তারা বাধ্য হয়ে পাটগুলো নামমাত্র মূল্যে দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত সরকার মহলে এই দালাল চক্র এতটাই শক্ত হয়ে গেলো যে সরকারও তখন এটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে নি। কেবল ১৯৭৪ সালেই আমাদের উৎপাদিত পাঠের ২০ শতাংশ ভারতে পাচার হয়ে যায়। বাকী যে পাটগুলো ছিল তা দিয়ে এই দালাল চক্রটিই বেশ দ্রুত সমৃদ্ধশালী হওয়া শুরু করলো। এখানে উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে সরকার এই পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করেছিল এবং এর দায়িত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনকে। কিন্তু এই জুট মিলস করপোরেশন গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। তার পর থেকে ধীরে ধীরে এই করপোরেশন আমাদের পাট শিল্প রক্ষা তো দূরে থাক এটাকে সরকারের একটা লসের খাতে পরিণত করে। তাদের দুর্নীতি পুরো অর্থনীতির মাজা ভেঙে দেয় সেদিন। এ বিপদ আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ ডেকে এনেছিল।

নতুন জন্ম নেয়া একটা দেশ। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। ক্ষমতার মোহে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দরা তখন সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এক প্রকার লাগামছাড়া যাকে বলে। এই ধ্বংসস্তুপ থেকেও তারা চুরির জিনিস খুঁজতে থাকে। খুঁজতে থাকে সংখ্যালঘুদের ফেলে যাওয়া জমিগুলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যত জমি হাতছাড়া হয়েছিল তার সিংহভাগ হয়েছে ৭২-৭৫ এই সময়টায়। এটা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে স্পষ্ট উঠে এসেছে। যদিও আশ্চর্যজনকভাবে এই দলটিকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা সব সময় ভরসা করে এসেছে।

রিলিফ চুরির ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। তার সাথে এও জানতে হবে যে, যে শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে এসেছিলেন সেই শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগ নেতাদের রিলিফ চুরির প্রতিবাদে ৩০ মার্চেই সাধারণ জনতার বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাদের বিক্ষোভটা এ কারণে ছিল না যে দেশে খাবার নাই। তাদের জন্য খাবার এসেছে কিন্তু তাও তারা সেটা পায় নি। স্বাধীন দেশে এই অন্যায়টুকু তারা কোনো মতেই মেনে নিতে পারে নি। এই বিক্ষোভগুলো মুহূর্তে পুরো দেশটাকে গ্রাস করে ফেলে। মানুষ যখন ক্ষুধার্ত থাকে তখন তার কাছে সব কিছু মূল্যহীন হয়ে যায়, ক্ষুধার জন্য তখন সে সব করতে পারে।

যে দেশ এই কয়দিন আগে মাত্র স্বাধীন হলো সেই দেশের অর্থনীতি মুহূর্তের মধ্যে ফটকাবাজদের হাতে চলে যায়। আর এরা সবাই কোনো না কোনো ভাবে সরকারী দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। স্বাধীনতার পর পরই একবার বন্যা হয় এবং একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সমস্যাগুলো স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের পক্ষে সামলানো কঠিন- মানলাম। কিন্তু জনগণের এই দুর্দশাকে কাজে লাগিয়েই তখন সরকার দলের মধ্য থেকেই একদল জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে বাড়াতে ৬০০-৭০০% করে দেয়। ফলে জনগণ তার অন্নের অধিকার হারায়। না খেতে পেরে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। তখন তো এই জনগণ বলবেই- ভাত দে হারামজাদা নয়তো মানচিত্র চিবিয়ে খাবো। একটু শান্তির জন্য যে সব জনগণ জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে শান্তি না পেলে তারা সব নিরবে মেনে নিবে এরকম ভাবা ভুল।

শেখ মুজিব আর উনার দল ভেবেছিল এই জনগণ স্বাধীন দেশে না খেতে পেয়েও উনাদের ভালোবাসবে। কিন্তু না, তখন ক্ষুধার যাতনায় তারা এই সরকারকেও ব্যর্থ বলে তার সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। যার কারণে ১৫ আগস্টের মত ঘটনাও তাদের সেই কঠিন মনটাকে গলাতে পারে নি। যে জনগণ পাকিস্তানী আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করলো তারা তখন ঐ ক্যূ করা ক্ষুদ্র শক্তিটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইলো না। কারণ ততদিনে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নটিকে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়েছিল সীমাহীন দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের “আইকন” শেখ মুজিবের মৃত্যুতে তারা একটি মিছিল দেয়াও প্রয়োজন বোধ করে নি। এই ক্ষুধাই তখন জনগণের মনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিবর্তে ধর্মীয় গোঁড়ামি ঢুকানোর জায়গা করে দেয়। মৌলবাদী শক্তিগুলো এই ব্যর্থতার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কার্ল মার্কস যেমনটা বলেছিলেন- শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিমস্বরূপ।

স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার ১১ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বিতরণ করেছিল। অথচ ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার এবং বাংলাদেশে ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিল ৭০-৮০ হাজার। এর বাইরে এত মুক্তিযোদ্ধা আসলো কোত্থেকে? আর সরকারই বা কেন এতগুলো সার্টিফিকেট দিলো? সরকার কি ভেবে দিয়েছে কে জানে। কিন্তু এই সার্টিফিকেট নিয়ে একদল যা শুরু করেছিল তা ছিল ভয়ংকর। তারা এখানে সেখানে তাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি ভাঙিয়ে শুরু করলো চাদাবাজি। ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনার চলে যাওয়ার পর এই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের ডাকাত দলগুলোর উৎপাত দিনকে দিন বেড়ে যেতে লাগলো। মানুষের মনে তখন প্রশ্ন- আমরা কি এক খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে আরেক খাঁচায় পড়লাম?

আমি যেটা বোঝাতে চাইছি সেটা হলো স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ এইসব দুনীতির কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধের পরে সব দেশই ধ্বংসস্তুপ থাকে। কিন্তু এটাও সত্য এই ধ্বংসস্তুপ অনেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উত্তরণ করে। ঠিক আমাদের সাথে স্বাধীনতা অর্জন করে ভিয়েতনাম এটা পেরেছে। আমেরিকা তো তাদের দেশটাকে বোমা মারতে মারতে শেষই করে দিয়েছিল। কিন্তু তাও তারা পেরেছে । কারণ তাদের প্রধান সম্পদ এরকম চুরি হয় নি। তাদের প্রশাসন এরকম দুর্নীতিগ্রস্থ হয়নি। আর সব থেকে বড় কথা তাদের সরকার এই দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয় নি।