12 July 2021

শ্রমিকদের কতটুকু মানুষ হিসেবে গন্য করা হয় এটাই বড় প্রশ্ন

 

বাংলাদেশে কারখানায় শ্রমিকের মৃত্যু এটা আবার নতুন কি! সাধারন হিসেবে এরা শ্রমিক আর এই শ্রমিকদের কতটুকু মানুষ হিসেবে গন্য করা হয় এটাই বড় প্রশ্ন। গত বছর করোনার শুরুতেই আমরা দেখেছি আমাদের দেশের পোষাক শিল্পের মালিকদের শ্রমিক নামক প্রানীদের নিয়ে নানান খেলা। পোষাক কারখানার কোন এক বহুরুপী মালিক তো তার ফেইসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে বলেই ফেললেন তারা নাকি শ্রমিকদের পালেন পোষেন। তার অর্থ কি দাড়ায়? এখনও দেশ যখন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বেসামাল তখনও কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে পোষাক কারখানা। শ্রমিকরাও পেটের তারনায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে ছুটছে কর্মক্ষেত্রে। অথচ সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি কারখানা মালিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব পরিবহনে শ্রমিকদের আনা-নেওয়া করে কারখানা খোলা রাখতে পারবে। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে এই কথাগুলি বলছি। কারন আমিও একজন শ্রমিক। 


গত ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের আওতাধীন হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সুত্রপাত হয়। কারখানার ছয় তলা ভবনটিতে তখন প্রায় চারশ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন । কারখানায় প্লাস্টিক, কাগজসহ মোড়কি করণের প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে। প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় কয়েকটি ফ্লোরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ২২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। শুক্রবার দুপুরে কারখানার ভেতর থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে, আগুনে পুড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। সবমিলে এ পর্যন্ত ৫২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। কারখানায় আগুনের ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। সব চেয়ে বেদনাদায়ক হলো মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও অনেক শ্রমিকই পরিবারের সদস্যদের কাছে ফোন করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু অসহায় পরিবারের সদস্যরা তাদে প্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে পুরো ই ব্যর্থ হয়েছেন। কারন অগ্নিকান্ড শুরু হওয়ার পরই কারখানা প্রবেশ ও বাহিরের গেইট গুলি তালাবন্ধ করে দেওয়া হয়। 

এই কারখানা কাজ করা অধিকাংশই নাকি ছিল শিশু শ্রমিক। স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী উদ্ধার করা প্রতিটি মৃতদেহই একেকটি কয়লার টুকরো। তার পরও ডিএনএ টেষ্টের মাধ্যমে নাকি মৃত ব্যক্তিদের সনাক্ত করা হবে। সজীব গ্রুপের কারখানার ঘটনায় বিস্তারিত আসার আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের ঘটনা একটু স্মরন করার চেস্টা করি। আমাদের বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি খুবই কম। আর কম হবেই না বা কেন, প্রতিনিয়ত ই এত ঘটনা ঘটছে এর কয়টাই বা মনে রাখা যায়। তাই কোন ঘটনারই তেমন কোন প্রতিকার হয় না বলেই ঘটনার তলে চাপা পরছে ঘটনা। সেই দিন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডর কারখানায় আগুনে পুরে ১১২ জন শ্রমিক কয়লা হয়ে গিয়েছিলেন। স্বজনরা সেই দিন তাদের প্রিয়জনের মরা মুখটিও দেখতে পারেননি। মৃত শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে সেদিন ভারি হয়ে গিয়েছিল নিশ্চিন্তপুরের আকাশ বাতাস। তবে সেই কান্না মিশে গেছে আকাশে আর বাতাসেই । সেই কান্না কোন ভাবে স্পর্শ করতে পারেনি আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা কর্তাব্যক্তিদের। তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডর কারখানায় আগুনে ঘটনার পর যখন আমাদের দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যম এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন উত্তাল তখনও আমরা এই প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসনকে ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব সহকারে নিতে দেখিনি। সরকারের কাছেও ঐ ঘটনার তেমন গুরুত্ব ছিল বলে আমার মনে হয় নাই।

ঠিক একই ভাবে সজীব গ্রুপের কর্নধার মোহাম্মদ আবুল হাসেমও বলেছেন, "আগুনের ঘটনার দায় তিনি নেবেন না। এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা।" হাসেম সাহেব একদম সত্য কথা বলেছেন। তিনি তো আর আগুন লাগাননি তার কারখানায়। শ্রমিকদের অবহেলায় কারনে আগুন লাগতে পারে তাও মেনে নিলাম। কারন কারখানা থাকলে শ্রমিক থাকবে, শ্রমিক থাকলে শ্রমিদের অবহেলাও থাকতে পারে। সর্বোপরি কারখানা থাকলে অগ্নিকান্ডসহ অঘটন ঘটবে এটা স্বাভাবিক। তবে কোন কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের কোন ব্যবস্হা থাকবে না বা কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ভিতরে অবস্হানরত শ্রমিকদের দ্রুত বের হওয়ার জন্য কোন জরুরি সিঁড়ি থাকবে না; সর্বোপরি শ্রমিকদের নিরাপত্তা কোন ব্যবস্হা থাকবে না; এমনকি অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনের মুল ফটক বন্ধকরে দিবে তা তো হতে পারে না। তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডর কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এত শ্রমিকের মৃত্যুর পরও আমরা একই কাহিনী শুনেছি আট তলা কারখানা ভবনে ছিল না কোন অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্হা ছিলা কোন জরুরী ভিত্তিতে বের হওয়ার কোন সিঁড়ি বা দরজা এমনকি অগ্নিকাণ্ডের সুত্রপাতের পরই নাকি কারখামার মুল ফটক তালাবন্ধ করে শ্রমিকদের আটকে দেওয়া হয়েছিল। তাই তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সাথে হুবহু মিল আছে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানার অগ্নিকান্ডের ঘটনার।

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী নিমতলী ট্র্যাজেডির কথাও আমরা সবাই ভুলে গেছি। ঐদিন এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১২৪ জন তরতাজা মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। হয়তো অনেকেই বলবেন কিভাবে ভুললাম প্রতিবছর তো ঐ দিনটি আসলে সংবাদমাধ্যমে এই নিয়ে নানান প্রতিবেদন হয়। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা তখন সরকারের কাছে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, যার প্রথম সুপারিশই ছিল পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্হান থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া। বাকি ১৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ওপর। কিন্তু, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের যথাযথ পদক্ষেপ আজো নেয়া হয় নাই বলেই গত ২৩ এপ্রিল ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসনের নীচতলায় রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেকেই জীবন দিতে হয়েছে আবার কেউ আগুনে দগ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেছেন। এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়ানক আরেক অগ্নিকাণ্ডের জীবন দিতে হয়েছিল ৭৮ জন মানুষকে। কারণ ঐ এলাকার প্রতিটি বাড়ীতেই ছিল সেই রাসায়নিক গুদাম। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলংকময় ঘটনার নাম রানাপ্লাজা দুর্ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। এ দূর্ঘটনায় প্রায় ১২০০ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। রানাপ্লাজার ঘটনার পর ভেবেছিলাম আমাদের সরকারে কর্তাব্যক্তিদের ভিতর হয়তো মানবতা জাগ্রত হবে। কিন্তু তা না হয়ে আমরা দেখেছি ভিন্ন চিত্র। রানাপ্লাজা ধসের দিন বিএনপির হরতাল কর্মসূচি ছিল আর এই ভবন ধসের দায় বিএনপির কাধে চাপানোর জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছিলেন, ‘‘কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন৷ ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে৷'' যদি এই কথা বলে দেশের মানুষের কাছে হাসির পাত্রে পরিনত হয়েছিলেন তিনি। পরে যদিও অনেক নাটকীয় ভাবে গ্রেফতার করা হয় রানাপ্লাজার মালিক সোহেল রানাকে। এর পর থেকে সোহেল রানা এখনো কারাগারে বন্দি। রানাপ্লাজার দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের সহযোগিতার জন্য দেশ বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন সহযোগিতার বেশির ভাগই নাকি চলে গেছে রাঘব বোয়ালদের পেটে। অসহায় শ্রমিকদের ভাগ্য সেই নির্মম পরিহাসেরই শিকার। সজীব গ্রুপের শিল্প প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকেই আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ্যক্টিভিষ্টরা খুবই সজাগ।

স্বাভাবিক ভাবেই একটি কারখানা স্হাপনের আগে আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কতৃপক্ষের কাছ থেকে বিভিন্নধরনের ছাড়পত্র নিয়েই কারখানা কার্যক্রম শুরু করতে হয়। এবং একটি কারখানায় কিছুদিন পর পর সেই সকল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো পরিদর্শন করে সব ঠিকঠাক আছে কি না তার তদারকি করা। তারমধ্যে বিশেষ করে রয়েছে কল-কারখানা পরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার ব্রিগেড, পরিবেশ অধিদপ্তর এমন কি বিশ্বের উন্নত দেশে স্বাস্থ্য বিভাগ ও কারখানর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্বে থাকেন। তবে সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের দেশে প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা ঘটার পরই জানা যায় নানান ত্রুটির কথা। লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর জানা যায় লঞ্চের অনুমোদন নেই। ভবনে আগুন লাগলে জানা যায় অনুমোদন নেই। গাড়ি দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই, ড্রাইভারের লাইসেন্স নেই। কারখানায় দুর্ঘটনার পর জানা যায় ওখানে কারখানার অনুমতি নেই, কারখানার ভিতরে কোন নিরাপত্তার ব্যবস্হা নেই। অথচ তদারকের দায়িত্বে থাকা নানা কর্তৃপক্ষ কিন্তু ঠিকই আছে! সজীব গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আমরা জানতে পারলাম কারখানা পরিদর্শক নিয়মিত প্রতিবেদন দিয়ে গেছেন ফ্যাক্টরি চালানোর উপযুক্ত বলে। অনেকগুলো লাইসেন্স ইতিমধ্যে মেয়াদ শেষ হয়েছে কিংবা ছিলই না গত কয়েক বছর। তার সাথে আগেই তো বলেছি ঐ কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের কোন ব্যবস্হা ও জরুরি নির্গমনেরবও কোন রাস্তা ছিল না।