16 December 2018

আর কবে আমরা তৈরী করবো নিজেদের?

আমাদের এই বাংলাদেশ কখনোই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। যে কারণে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলে সরকারি চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিয়োগ বেশি পেয়েছে। তখনকার ব্যাংকিং, বীমা প্রতিষ্ঠান, চা শিল্প, পাট শিল্প সহ বড় বড় কল কারখানার ব্যবস্থাপনা ও মেধাভিত্তিক কাজের জন্য যতো সংখ্যক দক্ষ জনশক্তির দরকার ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেই পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি আমরা সরবরাহ করতে পারিনি। ফলে তুলনামূলকভাবে নিম্নস্তরের কাজগুলোতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীরা কাজ করতো। মেধাবী বাঙালিরা ঠিকই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কিংবা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিতে পেরেছিল। কিন্তু মোট চাহিদার সামান্যই আমরা সরবরাহ করতে পারতাম। সে কারণে লেখাপড়া ও মেধায় তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানীরা সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্য ও উচ্চ পদে নিয়োগ পেতো।


স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই আমরা মেধাবীদের ঘাটতিতে পড়ে যাই। সেটা সরকারি প্রশাসনে এবং বেসরকারি পর্যায়ে। এমন অবস্থা হয় যে, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অল্প কিছু কর্মকর্তাদের নিয়েই আমাদের শুরু করতে হয়েছিল। এরপর অনেকটা ছাড় দিয়ে ১৯৭৩ সালে একটি বড় নিয়োগ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। সিভিল সার্ভিসের রেকর্ড বলে যে, শানিত মেধার একটি বড় টিম পেতে স্বাধীন বাংলাদেশকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এদিকে ঘাটতি পূরণে একটু একটু করে বিদেশীদের আগমন চলতে থাকে দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞ, এনজিওদের মাধ্যমে, কিংবা প্রকৌশল ও ভারী শিল্পক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্য। এখন বাংলাদেশে কর্মরত আনুমানিক ৫ লাখ বিদেশী বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের লেখাপড়ার যে মান আমরা গত কয়েক বছরে তৈরি করেছি তাতে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে উঠা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি কাজে বিদেশীদের নিয়োগ ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। তাতে করে মধ্যম আয়ের সুফল এদেশের বেশিরভাগ জনগণ পাবে না।

একটি নতজানু ও পরমুখাপেক্ষী শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘ চর্চা বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাকে দুরূহ করে তুলেছে। বিশেষ করে অকার্যকর পরীক্ষা ব্যবস্থার কারণে সার্টিফিকেটমূখী শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের দীর্ঘ সারি তৈরি করেছে, ফলাফল হিসেবে আগামীতে বাংলাদেশের একটি বৃহত্‌ জনগোষ্ঠী, যাদের বেশিরভাগ তরুণ, সংখ্যায় তারা কমবেশি ৫ কোটি হবে তারা জ্ঞান ও বুদ্ধিতে তাদের চেয়ে অগ্রসর বিদেশীদের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হবে। ততোদিনে বাংলাদেশে বিদেশীদের সংখ্যা এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ছাড়াবে। দেশে যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হচ্ছে সেখানে কল কারখানা তৈরি হবে ঠিকই কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিচের দিকে বাংলাদেশীরা প্রাধান্য পেলেও মিড ও টপ লেভেলে বাংলাদেশীদের আধিপত্য থাকবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

আবেগী জাতি হিসেবে আমরা হয়তো আগামীতে বিদেশী খেদাও আন্দোলন করার জন্য হাসফাস করব কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়া তো আমরা বিদেশীদের রিপ্লেস করতে পারব না। ফলে আমাদেরকে নিজেদের সক্ষমতার অভাবকে মেনে নিয়ে বিদেশীদের অধীনেই কাজ করতে হবে। বিকল্প যে নেই তা নয়। বিকল্প হলো সত্যিকারের তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যান যাচাই বাছাই করে নিজেদের অধিকারের কথা তুলে ধরা। এবং সর্বাগ্রে অকার্যকর প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান গলদ দূর করার জন্য দাবী জানানো। পাকিস্তান আমলে আমাদের সুবিধা ছিল- আমাদের একটা দৃশ্যমান শত্রু ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর নৃশংসতা ও বর্বরোচিত কর্মকান্ড আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছিল আমাদের নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভারও সহজে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সুযোগ কোথায়?


যে শিশুটা ১০ বছর আগে বিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিল ৬ বছর বয়সে সেই শিশুটা এখন ১৬ বছরের কিশোর। মেট্রিক পাস করে কলেজে যাবে। এই শিশুটি শিক্ষার পরিবর্তে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। যে সার্টিফিকেট তাকে একজন বিদেশীর গাড়ির ড্রাইভার, কিংবা বাসার হাউজ কিপার বা মালি কিংবা বড়জোর পিয়নের পদে কাজ করার সামর্থ্য দেবে। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাই কয়েক কোটি; এর বিপরীতে দুই চার দশজন প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এমআইটি, অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ডে পড়তে যায়। আরো কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দেশের মধ্যে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা নিতে পারে; এবং কয়েক হাজার বিদেশে পড়তে যায়। এরা একটি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতিতে কর্মপরিবেশে প্রবেশ করে। মোদ্দা কথা হলো- আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি অন্যায্য সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করেই যাচ্ছি, যার অবসান হওয়া দরকার। নিজেদের সত্যিকারের সক্ষমতাকে চেনা দরকার।