12 January 2016

সৌদি আরবে আকলিমার আত্মহত্যা ও আমাদের সম্মান বানিজ্য

২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে সৌদি আরবের রাজধানীতে আত্মহত্যা করেছেন আকলিমা আক্তার। তিনি কোন সৌদি নারী নন। তিনি এক হতভাগা এক বাঙালি মা, বাঙালি বোন। তিনি সেইসব হতভাগা নারীদের একজন যাদের আমাদের সরকার তুলে দিয়েছে সৌদি শেখদের অন্দর মহলে, নির্যাতিত হবার জন্য। তিনি তাদের একজন যাদের  ‘গৃহকর্মী’ মোড়কে ‘খাদ্দামা’ ভিসায় সৌদি আরবের বাসাবাড়িতে ক্ষুধার্ত নরপশুদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। পশুরূপী সৌদি কফিলের ভয়ানক নির্যাতন সইতে না পেরে রিয়াদে আত্মহত্যা করেছেন সেই আকলিমা আক্তার।

যে মা-বোনদের আমরা আমাদের সম্মান, আমাদের ইজ্জত হিসেভে জানি তাদেরই কিন্তু সৌদি নরপশুদের হাতে তুলে দিয়েছেন আমাদের সাবেক প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। জেনেশুনে ‘বলি’ দিয়েছিলেন গ্রামে-গঞ্জের সহজ সরল কয়েক হাজার নিরীহ মা-বোনদের। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ সৌদি রাজধানীতে আত্মহত্যা করা আকলিমা আক্তার (৩৬) তাঁদেরই একজন। ‘খাদ্দামা’ ভিসায় বাংলার মা-বোন যাঁদেরকে সৌদি পুরুষদের ‘খাদ্য’ বানানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে ফ্রি স্টাইলে, তারা কেউই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আত্মীয়-পরিজন নন।

প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সানারপাড়ের বাসিন্দা মজিবুল হকের কন্যা এবং বশির আহমেদের স্ত্রী আকলিমা গত ২৮ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছে তার কফিল (গৃহকর্তা) নিশান খুজাইম আল-সাহলী। মৃত্যুর ২ সপ্তাহ পর ১১ জানুয়ারি নির্যাতনকারী এই কফিলের তরফ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ চাওয়া হয় মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর নিমিত্তে। আকলিমা যেহেতু অচেনা-অজানা এক্স-ওয়াই-জেড তথা মন্ত্রী মশাই বা এমপি বাহাদুরদের কেউ নন, তাই দূতাবাসেরও এখানটায় মাথাব্যাথা না হওয়াই স্বাভাবিক। লজিক্যালি নো অবজেকশন!

আকলিমাদের হয়ে অবজেকশন জানাবার মতো কোন ‘আদম সন্তান’ যেহেতু সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন না, তাই রিয়াদ থেকে যথাসময়ে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ ইস্যু হবে, বিমানের বোঝা হয়ে আগে-পরে ঢাকায় ফিরবে মরদেহ, হবে দাফন। বাংলাদেশের যেহেতু প্রয়োজন বৈধ(!) উপায়ে জনশক্তি রপ্তানীর খতিয়ানকে ট্যাবলেট খাইয়ে মোটাতাজা করে ‘সরকারের সফলতা’র ফসল ঘরে তোলা, তাই দুই-চারজন আকলিমারা কয়েক মাস বাদে লাশ হয়ে ফিরলে বেয়াইতন্ত্রের কী আর আসে যায় ! মার্কামারা নারীবাদীরা যখন মুখে তালা লাগিয়ে সরকারের তৈল মর্দনে ব্যস্ত, তখন আকলিমার জীবিত বাবার আর্তনাদ কিংবা স্ত্রী হারানো স্বামীর বেদনায় শোকাহত হবার সময় নেই তাদের। নারীবাদের ‘সস্তা ব্যবসা’ শেষ হয়ে যাবে যে!

হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক না কেন, আকলিমা আক্তারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর জন্য আজ সর্বাগ্রে দায়ী বর্তমান এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কারণ টানা ৬ বছর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীণ তিনি একদিকে যেমন বারোটা বাজিয়েছেন বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারের, পাশাপাশি নিশ্চিত বিপদ জেনেও বাংলার মা-বোনদেরকে ‘খাদ্দামা’ ভিসায় সৌদি আরবের বাসাবাড়ির অভ্যন্তরে জাহান্নামে পাঠাবার জন্য কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে সৌদি কফিলদের দ্বারা যৌন নির্যাতন সহ ভয়াবহ টর্চারের মুখে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকার মতো দেশ যেখানে সৌদিতে নারী গৃহকর্মী (হাউজমেইড) প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে উদাসীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ চেয়েছিলেন বিমান বোঝাই করে বাংলাদেশের কয়েক লাখ নারীকে সৌদি পুরুষদের হাতে তুলে দিতে।

প্রযুক্তির কল্যানে এবং স্যোশাল মিডিয়ার আশীর্বাদে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের খায়েশ পূরণ হয়নি তখন, সাড়া পড়েনি ঢাকঢোল পেটানো নিবন্ধন তামাশায়। গ্রামে-গঞ্জে হাতে হাতে মোবাইল-টু-মোবাইল সৌদি মালিকদের টর্চারের ভিডিও ‘ভাইরাল’ হবার প্রেক্ষিতে লাখ লাখ নিরীহ মা-বোনেরা মোটাদাগে তখন বেঁচে গেলেও চিকনদাগে প্রায় হাজার বিশেক কিন্তু চালান হয়ে যান ঠিকই গত কয়েক বছরে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে তাঁদের মধ্য থেকেই আবার প্রায় আড়াই হাজার ইতিমধ্যে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং অনেকেই জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রহর গুণছেন। আকলিমার মতো অনেকেই প্রতিদিন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোন দিয়ে জানাচ্ছেন মনুষ্যসৃষ্ট জাহান্নামে তাদের চলমান আজাবের কথা। দ্রুত উদ্ধার করে দেশে পাঠানো না হলে বাড়তে থাকবে আত্মহত্যার ঘটনা।

কিন্তু তাতে কি আমাদের সরকারের টনক নড়বে? তারা কি উদ্যোগ নিবে এসব হতভাগাদের দেশে ফিরিয়ে আনার? নাকি এখনো জনশক্তি রপ্তানির নামে চলতে থাকবে এসব ইজ্জত রপ্তানি, এসব সম্মান বানিজ্য?