30 March 2015

ব্রাজিলে যেমন আছেন ৪ হাজার বাংলাদেশি

সাও পাওলো, পারানা, ব্রাসিলিয়া, রিও দি জেনেইরো সহ বিশাল দেশ ব্রাজিলের বিস্তির্ণ জনপদে, যেখানে জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত আছেন প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশি। ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকার সমন্বয়ে গড়া আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনৈতিক ফোরাম BRICS (ব্রিক্স)-এর অন্যতম দেশ ব্রাজিলকে সুদূরপ্রসারী টার্গেট করেই দু’বছর আগে রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ দূতাবাস। ব্রাসিলিয়াতে ৫শ’র মতো বাংলাদেশির বসবাস। শিল্পনগরী পারানা ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে হাজার দেড়েক আর বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতে বসবাস আরো প্রায় হাজার খানেক বাংলাদেশির। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন পুরো ব্রাজিল জুড়ে এমনকি অনেক প্রত্যন্ত জনপদেও।

অবাক বিষয় হলেও সত্য, প্রায় ৩ মিলিয়ন তথা ৩০ লাখ লেবানিজের বসবাস ব্রাজিলে। মূলতঃ তাদের কল্যানেই শিল্পনগরী পারানা সহ আশপাশের এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে হালাল ফুড ইন্ডাস্ট্রির এক বিশাল জগত। এক হাজারের ওপর বাংলাদেশি কর্মরত আছেন পারানা অঞ্চলের এই সেক্টরে, যাদের থাকা-খাওয়া-লন্ড্রি ফ্রি’র পর মাসান্তে হাতে আসে ৬ থেকে ৯শ’ ইউএস ডলার। বাংলাদেশিদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও সততার প্রশংসা করেছেন পারানা অঞ্চলের মালিকরা।

ব্রাসিলিয়ার ৫শ’ বাংলাদেশির মাঝে হাতে গোনা কয়েকজনের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থাকলেও অধিকাংশই বিভিন্ন শিল্পকারখানায় সুনামের সাথে কাজ করছেন। রাজধানীতে প্রভাবশালী বাংলাদেশি আছেন একেবারেই হাতেগোনা মাত্র দু’জন। প্রফেসর আমিরুল ইসলাম ব্রাসিলিয়ার স্থানীয় সরকারের শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা। অন্যজন কোটিপতি ব্যবসায়ী তারেক, যিনি রিয়িল এস্টেট ব্যবসায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন ব্রাজিলীয় রাজধানীতে।

বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতে যে হাজার খানেক বাংলাদেশি আছেন তাদের শতকরা ৯৯ ভাগই ব্যবসা-বানিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তবে এর জন্য তাদেরকে মালপত্র গাড়িতে ভরে যেতে হয় দূর দূরান্তে পূর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন মেলায়। ৫শ’ থেকে ১৮শ’ কিলোমিটারও তাদের পাড়ি দিতে হয় প্রতিনিয়ত। ব্যবসা করার জন্য ব্রাজিলে স্কুলে গিয়ে ব্যবসার ওপর পড়াশোনা করে পাশ করা সাপেক্ষে সার্টিফিকেট বা লাইসেন্স নিতে হয় না। রিফিউজি স্টেটাস নিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া-আসা সম্ভব না হলেও চাকরি বা ব্যবসা-বানিজ্য চোখ বন্ধ করেই করা যায় বছরের পর বছর।

চাকরির জগত থেকে দূরে থেকে যারা ব্যবসায়ির খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তারাই খুব ভালো আছেন অর্থনৈতিকভাবে। নিয়ম অনুয়ায়ি ব্রাজিলিয়ান প্রভাবশালী লোকজন মেলা বা বাজারের ইজারা নিয়ে থাকে প্রশাসনের কাছ থেকে এবং তাদের কাছ থেকেই ৩ থেকে ৪ দিনের জন্য বিশেষ মূল্যে পোস্ট কিনে নিতে হয় বাংলাদেশিদের। আলাদা করে সরকারকে টেক্স দিতে হয় না এবং প্রক্রিয়াগতভাবে তাদের ব্যবসার শুরুটা এক্ষেত্রে বৈধতার মাপকাঠিতে সাময়িক স্বীকৃত হলেও যেসব আইটেম তথা মালের ব্যবসা বাংলাদেশিরা করেন তা নিয়েই যতো ঘাপলা।

ব্রাজিলে দূর দূরান্তের মেলায় যেসব বাংলাদেশিদের ব্যবসা জমজমাট, তাদের প্রায় সবারই আইটেম দুই নম্বর মাল, অর্থাৎ নাইক-এ্যাডিডাস সহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল প্রোডাকশনের রকমারী পন্যসামগ্রী। দেখতে এবং ব্যবহারে অরিজিনাল পন্যের মতো হওয়াতে রীতিমতো ‘হট বিজনেস’ এই সেক্টরে, যার টোটাল প্রোডাকশনও ব্রাজিলেই। চাইনিজদের স্টাইলে বাংলাদেশিরাও কয়েকটি ফ্লোর সহ ভবন ভাড়া নিয়ে দিনরাত প্রোডাকশনে যায় এক্ষেত্রে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে হয় যথারীতি, তবে মেলায় ১ বার যদি মাল পুলিশ নিয়ে যায়, তা পরের ২ মেলাতেই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

পার্টনারশিপে ব্যবসা করলে চোখ বন্ধ করেই মাস শেষে আসে মিনিমাম ১ হাজার ইউএস ডলার আর অংশীদারিত্ব বাদ দিয়ে চোখ-কান খোলা রেখে একক ব্যবসায় মাসে ১০ হাজার ইউএস ডলারও খুব কঠিন নয়। সাও পাওলোর ডাউনটাউনে ‘ব্রাইস’ এলাকাটি যেন ‘বুড়িগঙ্গার ওপাড় জিঞ্জিরা’। এককথায় ‘ক্রাইম জোন’। সব হয় এখানে, পাওয়া যায় সব কিছুই। ব্রাইস-এর অন্ধকার জগতে অন্যান্য দেশিদের সাথে অবাধ বিচরণ বেশ কিছু বাংলাদেশির। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্থানীয় পুলিশের একটি অংশ নিয়মিত কমিশন পেয়ে থাকে সাও পাওলোর ‘জিঞ্জিরা’ খ্যাত ‘ব্রাইস’ এরিয়া থেকে।

বাংলাদেশের সাথে ৯ ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। শুধু সাত সমুদ্র তের নদী নয়, দেশটিতে আসতে মহাসাগরও পাড়ি দিতে হয় বাংলাদেশিদের। ব্রাজিল-বাংলাদেশ দু’দেশ সহ অন্যান্য দেশে আছে দালালদের সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্ক। ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে একসময় ঢাকা থেকে ফ্লাইটে প্রথমে নিয়ে আসা হতো প্রতিবেশী দেশ বলিভিয়াতে, তারপর চালান করা হতো ব্রাজিলে। গত বছর একসাখে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশি পৌঁছে বলিভিয়াতে। তবে বেশ কিছু অঘটনের পর আগেকার রুট আপাততঃ বন্ধ আছে এখন। তারপরও লোকজনের আসা থেমে নেই। বর্তমান রুট অনুয়ায়ি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ট্রানজিট নিয়ে ফ্লাইটেই চলে যেতে হয় মধ্য আমেরিকার দেশ পানামাতে। সেখান থেকে পোর্ট অব স্পেন পরবর্তি গায়ানার জর্জটাউন হয়ে একাধিক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসতে হয় ‘লাস্ট ডেস্টিনেশন’ ব্রাজিল।