21 March 2015

যে কারণে খুলছে না সৌদিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার

বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ওপর ৭ বছর আগে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এমন এক সময় প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হলো যখন সিংহাসনে আছেন সেই সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ, যাঁর ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের গোডাউনে ২০০৭ সালে সশস্র ডাকাতি এবং মিশরীয় নিরাপত্তা রক্ষীকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে ৮ বাংলাদেশির শিরোচ্ছেদ হয় ২০১১ সালে। রাজপরিবারের সদস্যদের যে কোন অন্যায়-অপরাধও বিগত দিনে কঠোর হস্তে দমনকারী তৎকালীণ ক্রাউন প্রিন্স সালমান তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাওয়া খুনী বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করতে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল থাকেন।

বাদশাহ সালমানের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া অঘটন ছাড়াও গোটা সৌদি আরব জুড়ে বাংলাদেশের মূলতঃ অদক্ষ শ্রমিকদের ব্যাপক অপরাধ প্রবণতার কারণে ২০০৮ সালে সৌদি সরকার বাংলাদেশ থেকে যে কোন পেশার দক্ষ-অদক্ষ সব ধরণের শ্রমিক আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাংলাদেশিদের শূন্যস্থান পূরণ করে নেয় অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ভারত সহ কয়েকটি দেশের শ্রমিকদের ‘অধিক বেতন’ চাহিদার ক্রমবর্ধমান চাপ মোকাবেলায় সামগ্রিক পরিস্থিতি ‘ব্যালেন্স’ করতে সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ থেকে পুনরায় জনশক্তি আমদানির।

সৌদি সরকার তাদের দেশের মালিকপক্ষের অর্থনৈতিক সাশ্রয় নিশ্চিত করতে তথা নিজেদের প্রয়োজনেই তুলনামূলক ‘লো-কস্ট লেবার কান্ট্রি’ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে পুনরায় শ্রমিক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সংবাদকে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসের তরফ থেকে এবং ঢাকায় সরকারীভাবে ‘কূটনৈতিক সাফল্য’ বলার তেমন কোন সুযোগ না থাকলেও ঢাকঢোল পিটিয়ে জোরেশোরে সেটাই প্রচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও আরেকটি কঠিন সত্য যে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও বাংলাদেশ সরকারের আত্মঘাতী ভুল পলিসি গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) বহাল থাকায় শ্রমবাজারের তালাবদ্ধ দুয়ারটি কিন্তু খুলছে না যৌক্তিক কারণেই।

প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রণীত ‘গল্প’ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় সৌদি প্রেরণের কাল্পনিক-অবাস্তব-অযৌক্তিক তথা ভিত্তিহীন প্রচারণা এবং এর মাধ্যমে বাস্তবতাকে আড়াল করার আত্মঘাতী প্রবণতাও শ্রমবাজার না খোলার নেপথ্যে দারুনভাবে কাজ করছে, এমনটাই জানা গেছে ব্যাপক অনুসন্ধানে। সৌদি আরবে যেখানে বিশ্বের কোন দেশ থেকেই জি-টু-জি’র মতো ‘উদ্ভট পলিসি’র আওতায় শ্রমিক আমদানি করা হয় না এবং সৌদি বেসরকারী রিক্রুটিং কোম্পানিগুলোই যেহেতু দেশটির শ্রমবাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের ‘এক্সপেরিমেন্টাল পলিসি’ জি-টু-জি’র খেসারতে ফলাফল মালয়েশিয়া চ্যাপ্টারের চাইতে ভালো হবার সুযোগ নেই বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গতঃ ১০০ মিলিয়ন রিয়াল সৌদি সরকারের কাছে ডিপোজিট রেখে লাইসেন্স পেতে হয় দেশটির বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্টদের এবং এরাই বছরের পর বছর ধরে তাদের ব্যবসার অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ-আধাদক্ষ এমনকি অদক্ষ শ্রমিক বা জনশক্তির যোগান দিয়ে আসছে দেশজুড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। ডমেস্টিক তথা বাসা-বাড়ির কাজের জন্য নারী-পুরুষ কর্মীর শতভাগ যোগানও দিয়ে থাকে সৌদি প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্টরা। টোটাল প্রক্রিয়াটি যেহেতু সৌদি রিক্রুটিং কোম্পানিগুলোর লাভজনক ‘বিজনেস’, সঙ্গতকারণে বাংলাদেশ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকায় শ্রমিক প্রেরণের বেহুদা আশ্বাস কোন যুক্তিতেই ধোপে টিকছে না।

গত ৭ বছর বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় অন্যান্য দেশের সাথে যে দু’টি দেশ ব্যাপকহারে জনশক্তি রপ্তানি করেছে সৌদি আরবে, সেই ভারত-পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। জনপ্রতি ভারতীয় শ্রমিকের জন্য সৌদি রিক্রুটিং এজেন্ট তার নিজ দেশের নিয়োগদাতা কোম্পানির কাছ থেকে ‘ভিসা’ কিনছে ২ হাজার রিয়াল দিয়ে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪০ হাজার টাকার ওপর। এর সাথে যোগ হয় দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের ফি-কমিশন এবং ওয়ান-ওয়ে এয়ার টিকেট। সবমিলিয়ে সৌদি পৌঁছতে একজন ভারতীয় শ্রমিককে দিতে হয় বাংলাদেশি টাকায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ। অন্যদিকে পাকিস্তানী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই অংকটি তিনগুণ বেশি কারণ তাদের জনপ্রতি ভিসার পেছনেই সৌদি রিক্রুটিং এজেন্টদের খরচা করতে হয় ৬ হাজার রিয়াল বা ততোধিক।

গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট তথা জি-টু-জি চুক্তির আওতায় সৌদি আরবে কোন শ্রমিক ভারত-পাকিস্তান থেকে না এলেও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে কেন এই ‘চাপিয়ে দেয়া’ বাধ্যবাধকতা ? সৌদি রিক্রুটিং কোম্পানিগুলো যেহেতু শত মিলিয়ন রিয়ালের বিনিময়ে বৈধতার লাইসেন্স নিয়ে এই সেক্টরের শতভাগ নিয়ন্ত্রক, সেক্ষেত্রে এখানকার প্রচলিত সিস্টেমকে ‘মাইনাস’ করে কেন জি-টু-জি’র বাদ্য বাজানো হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ? এখন প্রশ্ন হতে পারে, সবই যদি সত্য হয় তাহলে কেন সৌদি সরকারের ডেলিগেশন যাবে বাংলাদেশে ? মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি কূটনৈতিক সৌজন্যবোধ থেকেই ঢাকায় টিম পাঠাচ্ছে সৌদি আরব, যেমনটা তারা হরহামেশা পাঠিয়ে থাকে ভারত-পাকিস্তান সহ অন্যান্য দেশে।

জি-টু-জি’র আওতায় বাংলাদেশ থেকে জনপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা খরচায় বছরে ১ লাখ লোক পাঠানো হবে মালয়েশিয়াতে – এমন গল্পের ধরাবাহিকতায় সৌদি আরবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার কল্পকাহিনীর অবতারণা বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে না করলেই ভালো হতো, এমনটাই মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। বছরে ১ লাখ দূরে থাক, গত ২ বছরে মালয়েশিয়া গিয়েছেন মাত্র ৬-৭ হাজার এবং বৈধ রিক্রুটিং এজেন্টদের কাজ করার সুযোগ না থাকায় বারুদের বেগে বেড়েছে টেকনাফ-টু-মালয়েশিয়া সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার প্রবণতা। সাগরপথের অবৈধ রুট সাম্প্রতিককালে সম্প্রসারিত হয়েছে দুবাই-সৌদি আরব পর্যন্ত। ফলে প্রতারণা থেমে নেই, দিনকে দিন বড় হচ্ছে সলিলসমাধির তালিকা।

অভিবাসন ব্যয় কমানোর নামে প্রতারক দালালদের দৌরাত্ম বন্ধের কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকারের জি-টু-জি পলিসি যেভাবে শতভাগ ‘হিতে বিপরীত’ হয়েছে মালয়েশিয়াতে, ঠিক একইভাবে সৌদি আরবের ‘মরুভূমির মরীচিকা’ হওয়াও এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার। পাকিস্তানী শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় যেখানে (বাংলাদেশি টাকায়) আড়াই থেকে ৩ লাখ, ভারত যেখানে তা ৮০ হাজার-১ লাখের নিচে নামাতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল বাস্তববাদী হয়ে যৌক্তিক সব পদক্ষেপ নেয়া। সৌদি আরবে বছরের পর বছর জনশক্তি রপ্তানির অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে তেমনি একটি প্রস্তাব অতীতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেয়া হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা আমলে নেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

বাস্তবতার নিরিখে তথা যৌক্তিক ঐ প্রস্তাবে ছিল, লাখ লাখ বিদেশী জনশক্তির দেশ সৌদি আরবের এই সেক্টরটি যেহেতু শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে রিক্রুটিং এজেন্টরা, সেক্ষেত্রে সৌদি গমনেচ্ছুক বাংলাদেশিদের অভিবাসন ব্যয় সরকারীভাবেই দেড় থেকে ২ লাখ টাকার মধ্যে ‘ফিক্সড’ করে দেয়া। তবে কোন রিক্রুটিং এজেন্টের কাছে কেউ কোন টাকা দেবেন না এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রবাসী কল্যান ব্যাংকে যার যার একাউন্ট খুলে টাকা জমা করবেন বা রাখবেন। সৌদি রিক্রুটিং এজেন্টদের যেহেতু হাজার রিয়াল খরচা করেই নিয়োগদাতা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসা কিনতে হয়, সেহেতু তাদের সাথে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ থাকবে যথারীতি বাংলাদেশের বৈধ রিক্রুটিং এজেন্টদেরই।

উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় পাবলিক যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোথাও টাকা দিচ্ছে না বা দেওয়ার সুযোগও নেই, সেক্ষেত্রে প্রতারক দালালদের দৌরাত্মের প্রশ্নটিও এখানে আসবে না। কিস্তিতে বা এককালীণ টাকা আগে জমা দেবার ভিত্তিতে এবং কাজের দক্ষতা অনুয়ায়ী সরকার তার ডাটাবেজ-ডাটাব্যাংক থেকে চাহিদামাফিক জনশক্তির যোগান দেবে এমন কথা ছিল ঐ প্রস্তাবে। প্রতারক-দালালরা বিগত দিনে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে সত্য, কিন্তু মাথাব্যথার জন্য মাথাই কিন্তু কেটে ফেলা হয়েছে জি-টু-জি’র বদান্যতায়। সাধারণ জনগণকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করাই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হবে সেক্ষেত্রে সরকার খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বিবেচনা করতে পারতো বাস্তবসম্মত এই ‘মেকানিজম’। কিন্তু তা না করে ১৫-২০ হাজার টাকার কাহিনী রচিত হওয়ায় বাজছে শুধু ঢাকঢোল, খুলছে না শ্রমবাজার।