14 July 2012

নতুন প্রজন্মের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় এবং আওয়ামীলীগ এর পৃষ্টপোষকতা

সবসময়ই তরুণেরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তরুণেরা কীভাবে গড়ে ওঠছে, কীভাবে বেড়ে ওঠছে, কীভাবে ও কী শিক্ষা গ্রহণ করছে তার ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী হবে। সে রাষ্ট্র প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে উত্তীর্ণ হবে, নাকি পিছিয়ে পড়বে। নাকি স্থবির হয়ে পড়ে থাকবে, খাবি খাবে। সে কারণেই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে ভাবতে হয়। তবে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, তরুণ প্রজন্ম বেড়ে ওঠার ব্যাপার নয়, সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হয়। দরকার হয় যত্ন ও পরিচর্যার। সেটা যদি আমরা না করতে পারি তবে তরুণ প্রজন্মে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। যা গোটা জাতির জন্য এক মহাসর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত কয়েক দশক ধরে সেই যত্ন ও পরিচর্যার ঘাটতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অবক্ষয় অধঃপাতে যেতে বসেছে নতুন প্রজন্ম।

কিন্তু কেন এমন হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবের জন্যও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন নেই। বর্তমান প্রজন্ম যারা নেতৃত্বের আসনে বসে আছেন, তাদের আচার-আচরণ কথাবার্তা খেয়াল করলেও বোঝা যাবে যে, তারাও অবক্ষয়িত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যাদের বক্তব্য আমাদের প্রতিদিন পড়তে হয় ও শুনতে হয়, তাতে আমরা পাই বিস্তর ধোঁকা, অশালীন অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ প্রয়োগ, নির্লজ্জ মিথ্যাচার, ভন্ডামি, দম্ভ ও আত্মম্ভরিতা। পাই অসৌজন্য ও অসহিষ্ণুতা। জাতীয় সংসদও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় সংসদ অশালীন ও অশোভন মন্তব্যে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত স্পীকার বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, আপনাদের কথা শুনেই বোঝা যায় যে, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন। এটা লজ্জার। কিন্তু বিস্ময়ের নয়। কারণ, এরাও বেড়ে উঠেছেন এক অবক্ষয়িত সমাজের ভিতরে। পরিচর্যার মাধ্যমে এদের যত্ন করে গড়ে তোলা হয়নি। বর্তমান প্রজন্মের নেতৃস্থানীয় যারা তারা গত তিন চাঁর দশক ধরে অপরিকল্পিত লক্ষ্যহীন এক সমাজের ভেতর বেড়ে উঠেছেন। তাদের গড়ে তোলা হয়নি, পরিচর্যা করা হয়নি। ফলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তার অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এই পরিস্থিতি নতুন বিপদের জন্ম দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এদের কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে, তার সমমনা চরিত্রের তরুণেরা। সফল হয়ে ওঠার জন্য নতুন প্রজন্মের আদর্শ হচ্ছেন এরা। ফলে মেধাবি মননশীল তরুণরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে কিংবা তারাও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবে। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে অসততা, মূর্খতা, ভন্ডামি, মিথ্যাবাদিতা। অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের পাপের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতের জন্য বয়ে নিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম। দেশে এখন এমনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশ-জাতি-সমাজ যাত্রা শুরু করেছে এক গভীর অতল অন্ধকারের দিকে।

বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই তারুণ্য-নির্ভর। বহুকাল ধরেই এদেশের রাজনীতিতে শিক্ষিত মেধাবী যোগ্য লোকের আবির্ভাব কম ঘটছে। সাধারণভাবে পেশীশক্তি ও অর্থশক্তিই রাজনীতির নিয়ামক। সুশিক্ষিত মেধাবী ভদ্রজনেরা সক্রিয় রাজনীতিবিমুখ। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বিত্তহীন। উপরন্তু পেশীশক্তির কাছে তারা অসহায়। ফলে রাজনীতির গুণগতমান ক্রমঅপসৃয়মান। এই ধারা দীর্ঘকালের। ফলে রাজনীতিও মেধাহীনদের দখলে চলে গেছে। এতে দীর্ঘকাল ধরেই সাধারণ মানুষ ছাত্রদের ওপর, তরুণদের ওপর ভরসা করেছে। এবং এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছাত্র সমাজই থেকেছে সামনে। জনগণ যোগ দিয়েছে। সাধারণত জনগণের এরকম ধারণা আছে যে, ছাত্রসমাজ ন্যায় ও সত্যের ধ্বজাধারী। তারা লোভ-লালসার উর্ধ্বে, তারা দেশ ও জনগণের স্বার্থে অকাতরে জীবন দিতে কসুর করে না। কিন্তু তেমন পরিস্থিতি কি এখনও আছে? আমরা নিঃসংকোচে বলতে পারি নেই। কেন নেই? কারণ, সেটা আমরা বর্তমান প্রজন্মের ক্ষয়িষ্ণু নেতৃত্বই ধ্বংস করে দিয়েছি। আমরা নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাপ-পুঁজের সঞ্চার ও বিস্তার ঘটিয়েছি।

সামাজিক শৃক্মখলা নেতৃত্ব-নির্ভর। যদি সঠিক নেতৃত্ব থাকে, যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে সেই শৃক্মখলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যদি সদিচ্ছা না থাকে, যদি নেতৃত্বে কপটতা থাকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের বদলে আশু স্বার্থের আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসাবে গড়ে তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমরা তার বহু প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছি। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রধ্বংসী আন্দোলনের সময় যে তরুণ তার পিতৃতুল্য এক প্রবীণ কর্মকর্তাকে রাজপথে দিগম্বর করে ছেড়ে দিয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই নীতিহীন বর্বর তরুণের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা তো নেয়ইনি বরং পিতৃতুল্য প্রবীণকে রাজপথে দিগম্বর করার পুরস্কার হিসাবে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগের চাকরি দিয়েছে। জাতির জন্য এত বড় অপমান ও কলঙ্কের ঘটনা আর হতে পারে না। একইভাবে ছাত্রলীগের এক কর্মী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ জন নারী ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়ে বন্ধুবান্ধব ডেকে তার সেঞ্চুরি উৎসব পালন করেছে।

মানব সভ্যতার জন্য এ কী এক কলংকজনক অধ্যায় জনক, জননী, ভগিনীর জন্য এত বড় নিপীড়ন নির্যাতনে যখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মুখ কলংকের কালিমায় অবগুণ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তখন তিনি মহাসমারোহে ঐ কলঙ্কের পক্ষে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর অনুকূলে সাফাই গেয়েছেন। লজ্জায় গ্লানিতে গোটা দেশবাসী তাদের ধিক্কার দিয়েছেন। কিন্তু অবক্ষয়িতদের প্রতিনিধি যে সরকার, তাদের কাছেও ঐ ছাত্র এবং সাফাইবাজই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কী মহাকৃতিত্বই না ঐ ছাত্র ও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক ভাইস চ্যান্সেলর প্রদর্শন করেছেন! যার জন্য ঐ ভিসি আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-উপদেষ্টা হয়েছেন। আর সংশ্লিষ্ট ছাত্রকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দেয়া হয়েছে।

এই ইতর কর্মের পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কারের কি সত্যি কোন প্রয়োজন ছিল? এদের পুরস্কৃত করে অবক্ষীয়তদের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ সরকার জানান দিল যে, কেউ যদি শ্লীলতাহানির শততম পর্ব উদযাপন করতে পারে, তবে তাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেয়া হয়। কেউ যদি আল্লাহর আরশ কাঁপানো অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে, তবে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। কেউ যদি তার পিতৃতুল্য প্রবীণকে রাজপথে দিগম্বর করতে পারে, তবে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়া হয়।

যে ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের সকল ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, সে ছাত্ররাজনীতি এখন এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই রাজনীতি থেকে আদর্শ উধাও। ফলে তা অর্থবিত্ত-ভোগবিলাসের বাহনে পরিণত হয়েছে। ছাত্ররা নিয়োজিত হয়েছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও নারী নির্যাতনের নষ্ট উৎসবে। জন আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতে। অথচ সাধারণ মানুষের আকাক্মখা ছিল এ ধরনের অন্যায় অবিচার যেখানেই ঘটবে, তা প্রতিহত করার জন্য রুখে দাঁড়াবে ছাত্র সমাজ। নিজেদের ভগিনীদের সম্ভ্রম রক্ষায় তারা থাকবে হিমালয়ের মতো প্রতিরোধী হয়ে। কিন্তু দেখা গেল, তারা ইডেন-বদরুন্নেসা থেকে ছাত্রীদের ভয়-ভীতি-প্রলোভন দেখিয়ে তুলে এনে নিজেরাই তাদের সম্ভ্রমহানি ঘটাচ্ছে। এমন কি ১লা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যম পর্যায়ের ছাত্রনেতারা কনসার্টের সময় পাইকারিহারে প্রকাশ্যে ছাত্রীদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে। এখানেও ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু সে প্রতিরোধের আভাসও মেলেনি। এখানে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার সেই বোধও কি তবে লুপ্ত হয়েছে? হয়েছে। কারণ সেই নৈতিক শিক্ষা আমরা তাদের দিতে পারিনি। সমাজের বিপদটা হলো এই যে, এরাই ভবিষ্যত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এরাই এই সমাজের নেতা হবে। কী ভয়াবহ বিপজ্জনক সে পরিস্থিতি।

এই সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাই কিন্তু উত্তরণের উপায় কি? উপায় সমাজপতির বিষয়টি ভাবতে হবে। সমাজকে গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যেতে দেয়া যায় না। দিলে তা সামাজিক অনাচার যেমন আরো ব্যাপকতর করে তুলবে তেমনি রাষ্ট্রের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা গ্রহণ করেছেন তাদের ভাবতে হবে নতুন প্রজন্মে মাস্তান, খুনী, ধর্ষকদের যেন প্রশ্রয় দেয়া না হয়। এই প্রশ্রয় অন্যদের অপরাধীপ্রবণ কাজে প্ররোচিত করবে। এ সবকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মকে অর্থবিত্তে লোভী করে তুলছি। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দখলবাজিতে যারা লিপ্ত হচ্ছে, তারা সংক্ষেপে অর্থবিত্তের মালিক হতে চাইছে। আমরা তাদের প্রশ্রয় দিয়ে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এই অসৎ পথ উৎসাহিত করছি। এ রাষ্ট্রকে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।