12 July 2015

বৈদেশিক শ্রমবাজারের বারোটা বাজিয়ে অবশেষে চলে গেলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন

জি-টু-জি’র ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে অবশেষে বিদায় নিচ্ছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। না, মন্ত্রীসভা থেকে নয়, বিদায় নিচ্ছেন প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় থেকে। অনেকে বলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেবেরতো প্রমোশনই হলো’, কিন্তু কেন কোথায় কিভাবে হলো তা নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না জেল-জুলুমের ভয়ে। আমাদের আলোচনার বিষয়ও সেটা নয়, কিন্তু দিনের আলোর চাইতেও বেশি সত্য যে বিষয়টি না বললেই নয়, তা হচ্ছে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ‘প্রকৌশল বিদ্যা’ দিয়ে বিগত সাড়ে ৬ বছরে সাড়ে ৬ আনারও কল্যান হয়নি ১ কোটি প্রবাসীর। খেটে খাওয়া প্রবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর অবদান বরাবরই শূন্যের কোঠায়।

‘রেমিটেন্সের উৎস’ প্রবাসী বাংলাদেশীদের কোন প্রকার কল্যান দূরে থাক, ভুল পলিসি জি-টু-জি’র বদান্যতায় বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারের বারোটা বাজিয়ে তা সমূলে ধ্বংস করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে ‘প্রায় বিদায়ী’ এই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ‘প্রায় বিদায়ী’ বলা হচ্ছে কারণ, এলজিআরডি মন্ত্রনালয়ে ‘প্রমোশন’ হবার পর এখন তিনি ‘অতিরিক্ত’ দায়িত্ব হিসেবে প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়েও ‘অবশিষ্টাংশ’ বজায় রেখেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা রাষ্ট্রের ‘অতিরিক্ত’ নাগরিক কি-না সে আলোচনাও আজ নয়, তবে অচিরেই হয়তো নতুন কাউকে এখনানটায় ‘পূর্ণাঙ্গ’ দায়িত্বে দেখা যাবে এমনটাই স্বাভাবিক।

রসায়নের ভাষায় বলতে হয়, সকল ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সকল ক্ষারক ক্ষার নয়। ঠকবাজ বা প্রতারক সকলেই বৈধ বা অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্ট বা এজেন্সি, কিন্তু সকল রিক্রুটিং এজেন্ট বা এজেন্সি কিন্তু প্রতারক বা ঠকবাজ নয়। গত সাড়ে ৬ বছর এই বাস্তবতা থেকে বহু দূর দিয়ে হেঁটেছেন মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ‘হেভিওয়েট মিনিস্টার’ হবার সুবাদে তিনি কিন্তু চাইলেই পারতেন ঠকবাজ-প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে। কিন্তু না, মাথাব্যথার জন্য ঔষধের ধারেকাছে না গিয়ে মাথা কেটে ফেলার স্টাইলে আড়াই বছর আগে চালু করেন আত্মঘাতী ফর্মূলা জি-টু-জি।

‘নো মোর রিক্রুটিং এজেন্ট’ অর্থাৎ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি হবে শুধুমাত্র সরকারের সাথে সরকারের চুক্তির ভিত্তিতে, মূলতঃ এরই নাম গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট সংক্ষেপে জি-টু-জি পলিসি। অভিবাসন ব্যয় কমানোর ‘আইওয়াশ’ করে বাস্তবতা বিবর্জিত এই সিস্টেম চালুর আগে বলা হয়েছিল, শুধু মালয়েশিয়াতেই বছরে ১ লাখ কর্মী যাবে জি-টু-জি’র মাধ্যমে, তাও আবার জনপ্রতি ৩৩ হাজার টাকায়। নিবন্ধনের ঢাকঢোল পিটিয়ে তখন রাষ্ট্রের সাড়ে ৭ কোটি টাকা জলে ঢেলে সাড়ে ১৪ লাখ লোককে নিবন্ধন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জি-টু-জি চালুর পর এই পলিসির মহাব্যর্থতায় গত ৩০ মাসে বৈধভাবে মালয়েশিয়া গিয়েছেন সর্বসাকুল্যে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার কর্মী।

মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হেসেনের ভুল পলিসি জি-টু-জি’র খেসারতে মালয়েশিয়াতে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হবার ফলে দিনকে দিন বেড়ে চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার ভয়াবহ প্রবণতা। গত আড়াই বছরে কয়েক হাজার নিরীহ বাংলাদেশীর সলিলসমাধি হয়েছে টেকনাফ টু মালয়েশিয়া উত্তাল সমুদ্রপথে। বাংলাদেশের অনেক মায়েরা এখনো পথ চেয়ে বসে আছেন যদিও তাঁরা জানেন না আদরের সন্তানটি ফিরবে না আর কোনদিনই। জানবেনই বা কি করে ? মানুষ বোঝাই এমন বহু নৌকা-ট্রলার সাগরে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে, যেখানে সবারই সলিলসমাধি হয় তাৎক্ষণিকভাবে। এমন সব বহু ট্র্যাজেডি রয়েছে যেখানে একজনও না বাঁচাতে অনেক ক্ষেত্রে ঐসকল দুর্ঘটনা স্থান পায়নি সংবাদ মাধ্যমে।

এটাতো গেলো মালয়েশিয়ার কথা, এবার আসা যাক মধ্যপ্রাচ্যের মরুপ্রান্তরে। কারো আজানা নয় যে, একসময় বাংলাদেশ থেকে সবচাইতে বেশি কর্মী যেতো সৌদি আরবে। কিন্তু বাংলাদেশী নাগরিকদের দ্বারা সম্পাদিত চুরি-চামারি সহ বহুবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ‘বলি’ হিসেবে সৌদি শ্রম মন্ত্রনালয়ে আগেই ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হয়ে যায় বাংলাদেশ। কালো তালিকায় থেকে পার হয় বেশ কয়েকটি বছর। এরই মধ্যে সৌদি আরবের ঘরে ঘরে ভিনদেশী নারী গৃহকর্মীদের ওপর তাদের কফিলদের দ্বারা মানসিক-শারীরিক ও যৌন নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করায় ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলংকা সরকার সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবে চলছে মারাত্মক গৃহকর্মী সংকট। পরিস্থিতি সামাল দিতে সৌদি সরকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাংলাদেশের নারীদের ওপর। ঢাকার তরফ থেকে যেহেতু কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ তথা নিষেধাজ্ঞা যাতে সৌদি সরকার প্রত্যাহার করে নেয়, তাই এ যাত্রায় সুযোগ নেয় সৌদিরাও। “আগে নারী গৃহকর্মী তথা হাউজমেইড পাঠাতে হবে” এমন বিশেষ কন্ডিশনে বাংলাদেশের ওপর থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সৌদি শ্রম মন্ত্রনালয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, “আগে নারী তারপরে বাদবাকী” এই গোপন শর্তাবলীর ‘এ-টু-জেড’ দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে সযত্নে চেপে যান স্বয়ং মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

সত্য আড়াল করে এমন নাটককেই প্রচার করা হয় সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে। ঢাকাস্থ মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে এমনকি রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস ও জেদ্দার কনস্যুলেটের মাধ্যমে ‘আরব নিউজ’ পত্রিকাকে ‘ম্যানেজ’ করে ‘সৌদিতে শ্রমবাজার খুলে গেছে’ এবং ‘বিভিন্ন পেশায় লাখ লাখ কর্মী নেয়া হচ্ছে শীঘ্রই’ এমন সব ‘ফ্যাব্রিকেটেড’ তথা ভূয়া-ভিত্তিহীন-বানোয়াট সংবাদ প্রচার করানো হয় ২০১৪ সালের পুরোটা জুড়ে। অনেকটা বিনামূল্যে সৌদি যাবার ‘বোগাস’ প্রচারণায় ঢাকায় লাইন দেয় হাজার হাজার লোক, চলে ভাংচুর। মন্ত্রনালয়ের ছলচাতুরী অবশেষে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মন্ত্রীকে সর্বনিম্ন ভাষায় গালমন্দ করে ফিরে যান সবাই, রেখে যান ক্ষোভ। ঠিক এমন সময় মন্ত্রী ও মন্ত্রনালয় মনোযোগী হয়ে ওঠে সৌদিদের সেই গোপন ‘কন্ডিশন’ তথা নারী গৃহকর্মী সাপ্লাই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে।

দুবাইয়ের অলিতে গলিতে যেখানে বহু বছর ধরে আফ্রিকান জানোয়ারদের যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নারীরা, স্বদেশী মা-বোনদের কান্নায় যখন প্রতিনিয়ত আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে লেবাননে, তার কোন কুলকিনারা না করে উল্টো সৌদি আরবে ‘হাউজ মেইড’ পাঠাবার নামে নিরীহ নারীদের ইজ্জ্বত বিক্রি করতে উঠে পড়ে লাগে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়। জঘন্য সব বিকৃত যৌন রুচীর অশিক্ষিত-বর্বর এক শ্রেনীর সৌদি পুরুষদের চব্বিশ ঘন্টা সেক্স ভায়োলেন্সের মুখে বাংলার অজ পাড়া গাঁয়ের অবলা নারীরা নিজেদের কিভাবে কতটা সামাল দেবেন, তা ভেবে দেখার সময় পাননি দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

সরকারীভাবে নারীদের ডাক দেয়া হয় নিবন্ধনের। ৫ লাখ ১০ লাখ নারীকে নিবন্ধনের আওতায় আনার কথা বলা হলেও স্যোশাল মিডিয়া সহ রকমারী প্রচার মাধ্যমের আশীর্বাদে গ্রামে-গঞ্জের নারীদের কাছে আগেই পৌঁছে যায় সৌদি আরবের ঘরে ঘরে ঘটে চলা বিদেশী হাউজমেইডদের ওপর জঘন্য অত্যাচারের সংবাদ। মন্ত্রীকে হতাশ করে দিয়ে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের ৫ হাজার নারীও নাম লেখাননি সৌদি-নিবন্ধনের খাতায়। মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য আরো বেশ আগে থেকেই যারপরনাই হতাশ ছিলেন আরব আমিরাতে প্রত্যাশিত জনশক্তি রপ্তানিতে ব্যর্থ হয়ে। এক্সপো ভোটাভুটিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত ভোট না পেয়ে তখন নাখোশ হয় আমিরাত প্রশাসন।

প্রতি বছর এক লাখ করে তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ কর্মী নেয়ার যে পরিকল্পনা আমিরাত সরকারের ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে তা তারা পুরোটাই তুলে দেয় নেপালের হাতে। এক্সপোতে বাংলাদেশের ভোট না পেলেও নেপালের ভোটটি ঠিকই পেয়েছিল দুবাই। বাংলাদেশের ভুলে ২০১৪ সালে প্রায় লাখখানেক নেপালী কর্মীর কর্মসংস্থান হয় আমিরাতে। অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েও খন্দকার মোশাররফ হোসেন নেক্কারজনক ভূমিকা পালন করেন এক্সপো ভোটাভুটি ইস্যুতে। একই বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফর করলেও দূর হয়নি এক্সপোর ক্ষত, খুলেনি শ্রমবাজার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়াও সফর করেন, কিন্তু শুধুমাত্র জি-টু-জি’র কারণে বাংলাদেশের জন্য তালাবদ্ধ থাকে মালয়েশিয়ান শ্রমবাজার।

প্রতিশ্রতি দিয়ে মালয়েশিয়ার সরকার অবশ্য সবসময় কূটনৈতিক সৌজন্যবোধ দেখিয়ে এসেছে বাংলাদেশকে, কিন্তু বছর জুড়ে বিদেশী কর্মী ঠিক নিয়েছে এবং নিচ্ছে বাংলাদেশ ছাড়া বাদবাকি সব দেশ থেকে। মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সব জেনে এবং বুঝেও জি-টু-জি’র ব্যর্থতা ঘুণাক্ষরে স্বীকার করেননি অদ্যবধি। উল্টো জনশক্তি রপ্তানির ধ্বসের চিত্র ঢাকতে বিএমইটি’র মাধ্যমে তথ্য-জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি, যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একাধিকবার। মালদ্বীপের বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে অনেকে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও লিবিয়াতে পাড়ি জমালেও এইসব লোকদের নাম জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান তালিকায় উল্লেখ করা হয় মন্ত্রীর মিথ্যাচার সহ মন্ত্রনালয়ের ভূয়া পরিসংখ্যানের অনুকুলে।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানীর অসত্য তথ্য দিয়ে বারবারই জাতীয় সংসদকেও বিভ্রান্ত করেন প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের ‘প্রায় বিদায়ী’ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ইউরোপ আমেরিকা সহ বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠাচ্ছে সরকার এমন কথা সংসদে মন্ত্রী বললেও অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তথা এশিয়া মহাদেশ বাদে ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাভুক্ত যে প্রায় ১৩০টি দেশ রয়েছে, তার প্রায় ১০০টিতেই বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে কর্মী প্রেরণের আদৌ নজির নেই। মন্ত্রীর গোয়েবলসীয় প্রচারণা বহুবার দেশ-বিদেশে সবার হাসির খোরাক হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে তিনি থেকে যান বহাল তবিয়তে। তাই কে আসছেন নয়া দায়িত্বে এবং এসে কী করবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।