28 February 2015

খন্দকার মোশাররফই ধ্বংস করেছেন বাংলাদেশের শ্রমবাজার

ভাগ্যিস তিনি রাজাকার নন। তবে জন্মদাতা পিতা ফরিদপুরের কুখ্যাত রাজাকার নুরুল হোসেন ওরফে নুরু রাজাকার ছিলেন একাত্তরে স্থানীয় শান্তি কমিটির প্রভাবশালী নেতা। পাঠক, প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কথাই বলছি। পিতার পাপের প্রায়শ্চিত্ত পুত্রকে করতে হবে এমন নীতিতে খেটে খাওয়া প্রবাসীরা বিশ্বাসী নন, তবে সরকারের প্রতাপশালী এই মন্ত্রী গত কয়েক বছরে যেভাবে সমূলে ধ্বংস করেছেন বাংলাদেশের শ্রমবাজার, তাতে করে তিনি নিজেই কিন্তু আজ আবির্ভূত হয়েছেন ‘নব্য রাজাকার’ হিসেবে।

পরিবারতন্ত্রের যে বিশাল ভয়াবহ বিষবৃক্ষ বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে এবং করছে বছরের পর বছর, মূলতঃ তারই ধারাবাহিকতায় এমপি-মন্ত্রী হয়ে যান প্রকৌশলী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। নব্বই’র দশকে এলাকার রাজনীতিতে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র পর একানব্বই ও ছিয়ানব্বইতে পরপর দু’বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের তিক্ততা গ্রহন করেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ‘অটিজম বিশেষজ্ঞ’ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৮ সালে সাংসদ নির্বাচিত হবার পর সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়টি বাগিয়ে নেন তিনি।

মন্ত্রী হবার পর খন্দকার মোশাররফ বিগত ৬ বছরে নিজ এলাকায় দৃশ্যমান বেশ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন ঠিকই, তবে তার চাইতে বেশি অবদান রেখেছেন একান্ত নিজস্ব কিছু লোককে কালো টাকায় কোটিপতি হবার সুযোগ করে দিয়ে। একাত্তরের নরঘাতক পিতা কুখ্যাত নূরু রাজাকারের নামে রাস্তাঘাটের নামকরণ থেকে শুরু করে গোল্ডকাপ ফুটবল কিছুই বাদ রাখেননি এই ‘হেভিওয়েট’ মন্ত্রী। ‘লাইটওয়েট’ লোকজন যারাই তার জন্মদাতা পিতার ‘একাত্তর চাপ্টার’ নাড়াচাড়া করতে চেয়েছেন, তাদেরকে জাহান্নামের চৌরাস্তায় সযত্নে পৌঁছে দিয়েছেন খন্দকার মোশাররফ।

জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র অধীনে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় দেশে-বিদেশে সবার প্রত্যাশা ছিল খন্দকার মোশাররফ বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরো মজবুত করবেন। কিন্তু প্রত্যাশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিয়েছেন এই ‘সো কল্ড হাই প্রোফাইল’ মন্ত্রী। নেপথ্যে ‘যারপরনাই’ আনাড়িপনা ও একগুয়েমির খেসারতে বাস্তবতার বিপরীতে নেয়া একের পর এক ভুল পদক্ষেপ। প্রতারক দালালদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সাথে সঠিক সমন্বয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ আশ্রয় নেন শ্রমবাজার বিধ্বংসী ‘জি-টু-জি’ পলিসির।

মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের ‘অনুর্বর’ মস্তিষ্কপ্রসূত নীতিমালার বাস্তবায়ন হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানীর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্ট তথা প্রাইভেট সেক্টরকে দু’বছর আগে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় সরকার। সীমিত পরিসরে খোলা থাকে শুধু সরকারের সাথে সরকারের রাষ্ট্রীয় চুক্তির অধীনে জনশক্তি রপ্তানীর খুবই সংকীর্ণ পথ। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) চালু হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের বিশাল এই সেক্টরটির ধ্বংসের সব পথ প্রশস্ত হতে থাকে বারুদের বেগে। মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবক’টি দেশের দুয়ারে রীতিমতো তালা ঝুলে যায় ‘শুধুমাত্র’ বাংলাদেশের জন্য।

মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসমূহে মূলতঃ স্থানীয় প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমেই বছরের পর বছর বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ কর্মী নিয়োগ হয়ে আসলেও মন্ত্রী মোশাররফের ‘এক্সপেরিমেন্টাল পলিসি’ জি-টু-জি মুখ থুবড়ে পড়ে শুরুতেই। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বাধ্য করতে পারে না বা করার সুযোগও যে নেই, এই সহজ সত্যটি গত দু’বছরে বিন্দুমাত্র আমলে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে অতীতের মতো বর্তমানেও অন্যান্য সব দেশে থেকেই মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী নিয়োগ পুরোদমে চললেও শুধুমাত্র জি-টু-জিতেই থমকে যায় বাংলাদেশ।

জি-টু-জি বহাল রাখায় বৈদেশিক শ্রমবাজারের তালাবদ্ধ দুয়ারটি গত দু’বছরে বিন্দুমাত্র খোলেনি এবং খুলবেওনা – এটা বুঝেও কেন না বোঝার ভান করছে বাংলাদেশ সরকার ? সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ সফরে যাচ্ছেন বা যাবেন তখন সংশ্লিষ্ট দেশের নেতারা ‘সৌজন্যের খাতিরে’ আশার বাণী শোনাতেই পারেন এবং শুনিয়েছেনও। কিন্তু শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি এটা বোঝেন না যে, প্রাইভেট সেক্টরকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে জি-টু-জি তথা সরকারীভাবে কর্মী নিয়োগের জন্য আমিরাত বা সৌদি সরকার তার দেশের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের গর্দান নিতে যাবে না কোনদিনই।

মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ তার চাপিয়ে দেয়া আত্মঘাতী পলিসি জি-টু-জি দিয়ে যেভাবে ধ্বংস করেছেন বাংলাদেশের শ্রমবাজার, তা খুব ভালো করেই জানেন ও বোঝেন শেখ হাসিনা, এমনটিই দাবি সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের অনেকের। যদি তাই হয় সেক্ষেত্রে জি-টু-জি বাতিল অথবা বাস্তবতা বিবর্জিত এই ভুল পলিসি বহাল রেখেই প্রাইভেট সেক্টরের ওপর বিধিনিষেধ কেন তুলে নেয়া হচ্ছে না? স্বজনপ্রীতি আর দেশপ্রেম যে একসাথে অচল তা জেনেও প্রধানমন্ত্রী কেন মন্ত্রী মোশাররফকে জবাবদিহিতার উর্ধে রেখেছেন? অসাধু রিক্রুটিং এজেন্টদের আইনের আওতায় না এনে এবং প্রতারক দালালদের শাস্তির মুখোমুখি না করে আত্মঘাতী জি-টু-জিতে শ্রমবাজারে ধ্বংসযজ্ঞ আর কতকাল?

দেশের স্বার্থে তথা বৈদেশিক শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের স্বার্থে প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রয়োজনে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো আরো গুরুত্বপূর্ণ কোন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দিতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্সের চাকাকে সচল রাখতে খুব সহজেই কাজটি করে সবার প্রশংসাভাজন হতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। জি-টু-জি বাতিল বা সংস্কার দূরে থাক, মালয়েশিয়া ঘুরে এসে উল্টো তিনি বললেন, সরকার জি-টু-জিকেই আরো বেশি উৎসাহিত করতে চায়। নিন্দুকেরা বলছেন, “বেয়াই সাহেবের মান-ইজ্জত বলে কথা”।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে যদিও বারবার বলেছেন তিনি যে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে, তদুপরি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফকে জি-টু-জি’র এই মহাকলংক থেকে মুক্তি দিয়ে এখানটায় একটু ‘স্বজনপ্রীতি’ করার বিনীত অনুরোধ জানাই দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আজকের প্রধানমন্ত্রীকে। দেশের প্রয়োজনে তথা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ব্যতিক্রমধর্মী এই স্বজনপ্রীতিতে আর যাই হোক না হোক, খুলে যাবে শ্রমবাজারের তালাবদ্ধ দুয়ার। প্রয়োজন হবে না বারে বারে দেশের জনগনকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবার, আগেকার ন্যায় আবারো লাখ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হবে মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।